অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকে হুমকিতে কক্সবাজারের পর্যটন স্পট

দেশে অবকাশকালীন ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের শীর্ষ পছন্দের তালিকায় রয়েছে কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন। এ কারণে হোটেল-মোটেলসহ পর্যটনকেন্দ্রিক বিভিন্ন বিনিয়োগও সেখানেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আবার সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারির সীমাবদ্ধতায় এ দুই এলাকায় পরিবেশগত ক্ষতিও হয়েছে মারাত্মক আকারে। শুধু তা-ই নয়, গোটা দেশেই বনাঞ্চল, জলাভূমি, পার্বত্যাঞ্চল ও সাগরসৈকতকে ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলো দূষণ ও প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এর জন্য মূলত অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন কর্মকাণ্ডকেই দায়ী করা হচ্ছে বেশি।

দক্ষিণাঞ্চলীয় একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের ফলে সেখানকার বাস্তুসংস্থানে এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কভিডের কারণে মাঝে কিছু সময় বিরতির পর আবারো দ্বীপটিতে প্রতিদিনই অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় পর্যটকদের যাতায়াত শুরু হয়েছে। হোটেল-রিসোর্টগুলোর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীন আচরণের পাশাপাশি পর্যটকদের অসচেতনতার কারণে দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। প্লাস্টিকসহ নানা বর্জ্যের দূষণ এসব এলাকায় এখন প্রকট হয়ে উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, অপরিণামদর্শী ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো তৈরি এবং অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের ফলে সেন্ট মার্টিন, কক্সবাজার-টেকনাফ, সোনাদিয়া দ্বীপ, মহেশখালীসহ প্রধান পর্যটন অঞ্চলগুলোর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে মোট ১৩টি স্থানকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। দিন দিন এসব পর্যটন এলাকা প্রতিবেশগতভাবে আরো বিপন্ন হয়ে পড়ছে, যা এসব এলাকায় টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে সেন্ট মার্টিনের মতো নাজুক বাস্তুসংস্থানসংবলিত দ্বীপকে বাঁচাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দ্বীপটিতে যেকোনো ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করেই গড়ে উঠছে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে সরকার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছিল। প্রায় আট বর্গকিলোমিটার এলাকায় দ্বীপটিতে স্থায়ী প্রায় নয় হাজার বাসিন্দার বিপরীতে দৈনিক ভিড় করছে গড়ে আট হাজারের বেশি পর্যটক। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষের চাপ ঠেকাতে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১৪টি বিধিনিষেধ জারি করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। যদিও প্রতিনিয়তই সেগুলো লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

তবে পর্যটন অঞ্চলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যাপারে আইনের প্রয়োগ আরো কঠোর হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেক কিছুই অপরিকল্পিত হচ্ছে। পর্যটন অঞ্চলে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট আইন আছে। এখন এগুলো প্রয়োগ করা দরকার। আমাদের সরকার ও পর্যটনসংশ্লিষ্টদের যে বিষয়ে এখন গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো আইনের বাস্তব প্রয়োগ। কোনোভাবেই যেন পরিবেশের ক্ষতি না হয়, এ বিষয়টি নিশ্চিত করে তবেই পর্যটন এলাকায় অবকাঠামো ও অন্যান্য সেবা দিতে হবে।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো অবশ্যই পরিবেশ বিপর্যয় ঘটায়। পরিবেশ অধিদপ্তর এরই মধ্যে কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনসহ এখানেরই কয়েকটি এলাকা প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে। এটা মূলত পর্যটকদের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোর ফল। পর্যটন শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই সবকিছু পরিকল্পিত হওয়া উচিত বলে মনে করি।